নিজস্ব প্রতিবেদক: সিলেটের লোভাছড়ায় পাথর লুট করতে ‘ডেভিল’ ও ‘নন ডেভিল’ মিলেমিশে একাকার হয়েছেন। কোয়ারির জব্দকৃত পাথর ও নদী থেকে নতুনভাবে উত্তোলন করে বিক্রি করতে তারা একাট্টা হয়ে মাঠে নেমেছেন। কোয়ারি এলাকায় দফায় দফায় গোপন বৈঠক করে নানা পরিকল্পনাও করছেন। এ নিয়ে কোয়ারি এলাকায় সাধারণ ব্যবসায়ী ও জনসাধারণের মধ্যে ক্ষোভ বিরাজ করছে।
স্থানীয় একাধিক সূত্র জানায়, লোভাছড়ার জব্দৃকত এক কোটি ৫ হাজার ঘনফুট পাথরের মধ্যে প্রায় ৪৪ লাখ ঘনফুট পাথর একটি সিন্ডিকেটের কাছে নিলাম সম্পন্ন করে খনিজসম্পদ উন্নয়ন ব্যুরো (বিএমডি)। আর গোপন করা হয় প্রায় ৫৬ লাখ ঘনফুট পাথর। বিএমডির একাধিক কর্মকর্তার যোগসাজশে নিলামে এই সাগরচুরির ঘটনা ঘটেছে। এখন নিলামে গোপন ৫৬ লাখ ঘনফুট পাথর ও নদী থেকে নতুনভাবে আরও পাথর উত্তোলন করে বিক্রির জন্য স্থানীয় আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাপার নেতারা হাতেহাত মিলিয়ে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ১নং লক্ষী প্রসাদ পূর্ব ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি তমিজ উদ্দিন চেয়ারম্যান, ২নং লক্ষীপ্রসাদ পশ্চিম ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি কামাল উদ্দিন মেম্বার, কানাইঘাট উপজেলা জাপার যুগ্ম আহবায়ক আব্বাস উদ্দিন, ১নং লক্ষী প্রসাদ পূর্ব ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি আশরাফুল আম্বিয়া ও ইউনিয়ন যুবলীগনেতা সাহাব উদ্দিনের নেতৃত্বে এসব হরিলুট চলছে। আর এসব নেতৃবৃন্দকে পর্দার আড়াল থেকে পরামর্শ ও সহযোগিতা করে যাচ্ছেন সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের বন ও পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদক মস্তাক আহমদ পলাশ। তবে নেতৃবৃন্দ এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তাঁেদর সবার বক্তব্য হলো প্রতিহিংসা পরায়ণ হয়ে একটি মহল অপপ্রচার চালাচ্ছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় বিএনপি ও ছাত্রদলের একাধিক নেতা জানান, গত ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলেও এসব নেতারা মিলেমিশে কোয়ারিতে লুটপাট করেছিলেন। সেই সখ্যতা এখনও চলছে। পট পরিবর্তন হলেও লোভা কোয়ারিতে কোন পরিবর্তন আসেনি। আওয়ামী লীগের নেতারা কোয়ারিতে এখনও নিয়ন্ত্রণ করছেন। আর বিএনপি নামধারী নেতারা দলের পদ ব্যবহার করে ডেভিলদের সহযোগিতা করছেন। কোয়ারি এলাকায় ভাগ-বাটোয়ারা করে খাওয়ার জন্য ‘ডেভিল’ ও ‘নন ডেভিল’ মিলেমিশে একাকার হয়েছেন।
সূত্র আরও জানায়, গত মঙ্গলবার সকাল ১১টার দিকে লোভা কোয়ারি এলাকায় লক্ষীপ্রসাদ পশ্চিম ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি কামাল উদ্দিন মেম্বার, কানাইঘাট উপজেলা জাপার যুগ্ম আহবায়ক আব্বাস উদ্দিন ও ১নং লক্ষী প্রসাদ পূর্ব ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি আশরাফুল আম্বিয়ার নেতৃত্বে অন্তত: ১০-১২ জনের এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে নেতারা লোভা নদী থেকে কিভাবে নতুন করে পাথর উত্তোলন করা যায় তা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা করেন।
এদিকে, দুই উপদেষ্টার নির্দেশনা কানাইঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কানে পৌঁছায়নি। গত ৩দিন আগে সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার জাফলং এলাকা পরিদর্শনকালে বিদ্যুৎ, জ¦ালানি ও খনিজ উপষ্টো মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান ও পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান সিলেটের সব পাথর কোয়ারি বন্ধ থাকার নির্দেশনা জানান। এসময় দুই উপষ্টো কোয়ারি এলাকার ক্র্যাশার মেশিন বন্ধ রাখতে বিদ্যুৎ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করার নির্দেশানও দেন। কিন্তু সেই নির্দেশনা কানাইঘাটের লোভাছড়ায় বাস্তবায়ন হয়নি। । স্থানীয় প্রশাসনের রহস্যজনক নীরবতার কারণে আওয়ামী লীগ নেতা তমিজ চেয়ারম্যান সাউদগ্রামের পশ্চিমে জব্দকৃত পাথর ক্র্যাশার মেশিন এবং স্কেভেটর দিয়ে দিয়ে পাথর ভাঙ্গা ও স্টিলের নৌকায় উঠানোর কাজ করছেন। তার মতো আরও অনেকেই করছেন বলে জানা গেছে। এতে পরিবেশ দূষিত হচ্ছে। এছাড়া নদী থেকে পাথর উত্তোলন করে বিক্রি করছে একটি চক্র। এ ব্যাপারে কানাইঘাট উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা তানিয়া আক্তার বলেন, পাথর উত্তোলন বন্ধ রাখতে বিজিবিকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। আর ক্র্যাশার মেশিনের বিষয়ে খোঁজ নিয়ে অভিযান চালানো হবে।
এদিকে, মঙ্গলবার গভীর রাতে সিলেটের দক্ষিণ সরমার গোঠাটিকর এলাকায় সুরমা নদী থেকে পাথরবোঝাই ৯টি স্টিলবডি নৌকা আটক করা হয়। বিষয়টি নিশ্চিত করে সিলেট মেট্টোপলিটন পুলিশের মোগলাবাজার থানার ওসি ফয়সাল আহমদ জানান, গোটাটিকর এলাকার নজরুল ইসলামের নেতৃত্বে স্থানীয় লোকজন পাথরবোঝাই কয়েকটি নৌকা আটক করে পুলিশের কাছে হস্তান্ত করেছেন।
গোটাটিকরের সামি এন্টারপ্রাইজের স্বত্তাধিকারী নজরুল ইসলাম জানান, ২০২০ সালের জুলাই মাসে লোভাছড়া কোয়ারি থেকে অবৈধভাবে উত্তোলন করে মজুদ করা প্রায় এক কোটি ঘনফুট পাথর জব্দ করে প্রশাসন। পাঁচ বছর পর খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ব্যুরো (বিএমডি) ৫৬ লাখ ঘনফুট পাথর গোপন করে ৪৪ লাখ ঘনফুট পাথর নিলামের জন্য দরপত্র আহ্বান করে। এ ঘটনায় তিনি জনস্বার্থে উচ্চ আদালতের ধারস্থ হন। অভিযোগ বিচারাধীন থাকাবস্থায় আদালতের নির্দেশ উপেক্ষা করে বিএমডি সর্বোচ্চ দরদাতা হিসেবে পিয়াস এন্টারপ্রাইজ নামের একটি প্রতিষ্ঠানের কাছে জব্দকৃত ৪৪ লাখ ঘনফুট পাথর বিক্রি করে দেয়। এর বিরুদ্ধেও তিনি আদালতের ধারস্থ হয়েছেন।
নজরুল অভিযোগ করেন, বিএমডি ৪৪ লাখ ঘনফুট পাথর নিলাম করলেও মূলত বিক্রি করেছে ১ কোটি ঘনফুট পাথর। গোপন যোগসাজশে বিএমডি ৫৬ লাখ ঘনফুট সিন্ডিকেটের হাতে তুলে দিয়েছে। এর নেপথ্যে রয়েছেন জেলা আওয়ামী লীগের বন ও পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদক মোস্তাক আহমদ পলাশ ও ১নং লক্ষীপ্রসাদ পূর্ব ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি তমিজ উদ্দিন চেয়ারম্যান। তারা পিয়াস এন্টারপ্রাইজের নাম ব্যবহার করে ‘সাগর চুরি’ করছে। এখন আদালতের নির্দেশ অমান্য করে তারা লোভাছড়ায় জব্দকৃত ১ কোটি ঘনফুট পাথর পাচারের চেষ্টা করছেন। মঙ্গলবার গভীর রাতে পাচারকালে ৯টি নৌকাবোঝাই পাথর আটক করে পুলিশে দেওয়া হয়েছে।
সার্বিক বিষয় নিয়ে সিলেটের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদের সাথে কথা হলে তিনি বলেন, লোভাছড়ার বিষয়ে খোঁজ নিয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
Dhakapressbd/19.6.25
